Odhikar

ত্রৈমাসিক মানবাধিকার প্রতিবেদন : জুলাই-সেপ্টেম্বর ২০২৫

১৯৯৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে একটি মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে অধিকার রাষ্ট্র কর্তৃক সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো সব সময় তুলে ধরেছে। অধিকার ২০২৫ সালের জুলাই-সেপ্টেম্বরের প্রতিবেদন যখন প্রকাশ করছে, তখন গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সাড়ে ১৫ বছরের কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতনের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৩ মাস অতিক্রম করেছে। এই সময়েও অনেক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তিন মাসের এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে এবং এগুলো পর্যালোচনা করে রাষ্ট্রকে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করার ব্যাপারে সতর্ক করা হচ্ছে।

২০২৪ সালের ৫ অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত, ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী কর্তৃত্ববাদী শাসক শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের ৮ অগাস্টে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্তক তার দল আওয়ামী লীগের কর্মকা- নিষিদ্ধ হয়। ভারতে বসে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ভারতীয় শাসক গোষ্ঠীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে দেশকে অস্থিতিশীল  করার জন্য নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। ফলে দেশে বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকা- বৃদ্ধি পেয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার ২০১৬ সালে বেসরকারি সংস্থা (এনজিও)’র ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপের জন্য বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন পাশ করে। এই আইনের ১৪ ও ১৫ ধারায় কোন এনজিও বা এনজিওর কর্মকর্তা সংবিধান বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে বিরূপ বা অশোভন কোন মন্তব্য করলে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রাখা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী, সংসদ, বিচার বিভাগ, আইন কমিশন, নির্বাচন কমিশন ও এ্যাটর্নি জেনারেল সম্পর্কে কোন বিরূপ বা অশোভন মন্তব্য করা হয়েছে মর্মে সরকারের কাছে প্রতীয়মান হলে এনজিও’র নিবন্ধন বাতিল বা স্থগিত করা যাবে। বেসরকারী সংস্থাগুলো, বিশেষ করে মানবাধিকার সংস্থা যারা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে কাজ করে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি অবিচারের প্রতিকার চায়, তাদের কর্মকা- বন্ধ করার লক্ষ্যে এই আইনটি করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দ্রুত এই আইন পরিবর্তন করা। এছাড়া, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবিলম্বে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদ (সিডো) এর আর্টিকেল ২ (গ) এবং ১৬ (১) এর ওপর থেকে আপত্তি তুলে নিতে হবে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে এমন একটি প্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু বর্তমান আইনে এই কমিশনের কাজ সীমিত, যা এর স্বাধীনতাকে খর্ব করছে। অথচ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন ও স্বচ্ছ নিয়োগের মাধ্যমে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে একটি শক্তিশালী ও কার্যকরী রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজন রয়েছে।

হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যুর ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। নির্যাতনের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে দায়মুক্তির সংস্কৃতি চালু থাকা এবং এটি বন্ধে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ এর বাস্তবায়ন না হওয়ার কারণেই বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হেফাজতে নির্যাতন ও অমানবিক আচরণের ঘটনাগুলো অব্যাহতভাবে ঘটছে।

২০২৫ সালের ১৭ জুলাই অন্তর্বর্তীকালিন সরকার কনভেনশন এগেইনস্ট টর্চার-এর অপশোনাল প্রোটোকল অনুমোদন করে। এটি অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন। উল্লেখ্য, অধিকার গত ৩০ বছর ধরে এটির অনুমোদনের জন্য অব্যাহতভাবে দাবি জানিয়ে আসছিলো। বন্দি ও আটককৃতদের সুরক্ষা দেবার জন্য জাতীয় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গঠন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।

এছাড়া, কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের আমলে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত সামরিক বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ থেকে পালিয়ে গেছে, তাদের বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য কোন অগ্রগতি নেই।

গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য অভিযোগ থাকার কারণে র‌্যাবের অবলুপ্তির জন্য মানবাধিকার কর্মীদের পক্ষ থেকে দীর্ঘদিন ধরে দাবী তোলা হয়েছে, যা আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।

এক দিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা ও নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে, সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা ও  অন্যান্য মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ভারতীয় শাসক গোষ্ঠী বাংলাদেশে অবৈধভাবে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে জোরালো ভূমিকা নিতে হবে এবং সীমান্ত আরো শক্তিশালী করতে হবে।

অধিকার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকার কর্মীদের পাঠানো প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে।

Subscribe

Subscribe to our e-mail newsletter to receive updates.

, , , , , , , , ,