Odhikar

পাবলিক বাসে যৌন হয়রানী এবং গণ ধর্ষণঃ বিচার এবং প্রতিকার চাই

দেশে পাবলিক বাসে মেয়ে যাত্রীদের উপর যৌন হয়রানী বহুবছর ধরে প্রতিকারহীনভাবে চলছেই। অপ্রতুল পাবলিক বাসের অভাবে ভিড়ের সুযোগে কিছু বিকৃত মানসিকতার পুরুষযাত্রী মেয়েযাত্রীদের যৌন হয়রানী করে চলেছে, বাসের হেল্পাররা মেয়েদের বাসে উঠা- নামার সময় অহেতুক গায়ে হাত দেয় – এই রকম অসংখ্য অভিযোগ আছে তবু এর কোন প্রতিকার হচ্ছেনা। মেয়েরা প্রতিদিন যৌন হয়রানীর আতংক এবং এর শিকার হয়ে পাবলিক বাসে চলাচল করছেন। বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের সাম্প্রতিক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে গণ পরিবহণে যাতায়াতকারী ৯৪% নারী যৌন হয়রানীর শিকার হচ্ছেন এবং এই হেনস্থা কারীদের ৬৬% পুরুষের বয়স ৪১-৬০ বছরের মধ্যে এবং ৩৫% নারী জানিয়েছেন তাঁরা ১৯-২৫ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারা যৌন হয়রাণির শিকার হয়েছেন। ব্র্যাকের গবেষণা প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে যে শিকার হওয়া নারীদের ৮০.৭% প্রতিবাদ করেন না বা কোন ব্যবস্থা না নিয়ে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন। এই থেকে কি বোঝা যাচ্ছে না যে নারীরা ভীষণ ভাবে আশাহত? ৮০% এর বেশী নারী প্রতিবাদ করছেন না কারণ তাঁরা দেখছেন যে প্রতিবাদ করে কোন লাভ হয়না। এটা কি ভয়াবহ অবস্থা না? একে তো নারী যাত্রীরা এই ধরণের অসুস্থ মানসিকতার পুরুষ যাত্রীদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ, এর মধ্যে ২০১৩ সাল থেকে পাবলিক বাসের চালক এবং তার সহযোগীদের দ্বারা চলন্ত বাসে মেয়ে যাত্রীদের গণধর্ষণ বা ধর্ষণের উদ্দেশে যৌন হয়রানীর ব্যাপারে অভিযোগ আসা শুরু হয়েছে। ভারতে ২০১২ সালের ডিসেম্বরে চলন্ত পাবলিক বাসে একটি মেয়েকে গণধর্ষণ করার ফলে মেয়েটি মারা যান। ভারতের ঐ ভয়াবহ ঘটণার অনুকরণ করে বাংলাদেশেও কিছু বাস চালক এবং তাদের সহকারীরা মেয়ে যাত্রীদের চলন্ত বাসে অথবা বাস থেকে তুলে নিয়ে অন্য জায়গায় আটকিয়ে গণধর্ষণ করা শুরু করে দিয়েছে।এইসব বেশির ভাগ ঘটনাতে দেখা যাচ্ছে- ভিক্টিম মেয়েটি যদি রাতের কিংবা ভোরের যাত্রী হন, শেষের স্টপেজের যাত্রী হন তখন মেয়েটি বাসে উঠার পর দেখা যায় চালক এবং তার সহকারীরা আর অন্য কোন যাত্রীকে বাসে উঠতে দেয়না বা বাসে ত্রুটি আছে বলে আগেই অন্য যাত্রীদের নামিয়ে দেয় – এইভাবে এরা যে কোন নারীকে ধর্ষণের জন্য টার্গেট করে এবং টার্গেট নারীটি ছাড়া তারা বাস জনশূন্য করে ফেলে। আবার টার্গেট নারীটি যাতে বুঝতে না পারে যে বাসে তিনি একা – সেক্ষেত্রে কিছু কিছু ঘটনায় দেখা যায় তারা তাদের লোকজনদের যাত্রী সাজিয়ে বাসে বসিয়ে রাখে– যারা কিনা পরবর্তীতে মেয়েটির ধর্ষণকারী হয়ে আত্মপ্রকাশ করে।

আমার জানা মতে চলন্ত পাবলিক বাসে প্রথম গনধর্ষণের অভিযোগ পাওয়া যায় ২০১৩ সালের ২৪শে জানুয়ারীতে। ঐদিন মানিকগঞ্জের ঢাকা-আরিচা হাইওয়েতে ‘শুভযাত্রা পরিবহন’ এ একজন নারী গার্মেন্টস কর্মীকে বাসের চালক এবং সহকারী ধর্ষণ করে রাস্তার পাশে ফেলে রেখে চলে যায়। মেয়েটির কাছে বাসের ভাড়ার জন্য খুচরা টাকা ছিলনা- তাই তিনি ১০০০ টাকা দিয়েছিলেন । বাস সহকারী বলেছিল তাঁকে বাকী টাকা ফেরত দিবে। কিন্তু মাঝ রাস্তায় বাস নষ্ট এই কথা বলে তারা সব যাত্রীদের নামিয়ে দেয়- মেয়েটিকে তারা বাকী টাকা ফেরত দিবে বলে বাসে বসতে বলে। কিন্তু এরপর বাস চালু করে কিছুদূরে নিয়ে চলন্ত বাসে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে।এই ঘটনার পর পুলিশ বাস চালক এবং এর সহকারীকে গ্রেফতার করেছিল- কিন্তু এরপর কি হল জানা যায়নি । গত এপ্রিল মাসেও ধামরাইয়ে একজন নারী গার্মেন্টস কর্মী রাত ১০টায় তাঁর কাজ শেষে বাসায় ফেরার জন্য ‘যাত্রীসেবা’ নামে একটি লোকাল বাসে উঠলে বাসটি ধামরাইয়ের কালামপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় পৌঁছালে মেয়েটি ছাড়া সব যাত্রী বাস থেকে নেমে গেলে বাসের দরজা-জানালা বন্ধ করে ড্রাইভার সহ ৫ জন মেয়েটিকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণ করে। মেয়েটির চিৎকার শুনে একটি পেট্রোল পাম্পের কর্মীরা ধামরাই থানা পুলিশকে খবর দিলে পুলিশ ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের এলাকা থেকে ভুক্তভোগী মেয়েটিকে উদ্ধার করে এবং ৫ জনকে আটক করে। ২০১৬ সালের এপ্রিলেও একজন গার্মেন্টস কর্মী ’বিনিময়’ নামের লোকাল বাসে করে ভোর ৬টায় তাঁর আত্মীয়ের বাসা থেকে ফেরার পথে টাঙ্গাইল- ময়মনসিংহ মহাসড়কে চলন্ত বাসে ৩ জন বাসের কর্মী দ্বারা গণধর্ষণের শিকার হন। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বগুড়া থেকে ময়মনসিংহে ‘ছোঁয়া’ বাসে যাওয়ার সময় রূপা খাতুন নামে একজন আইনের ছাত্রীকে বাসের চালক এবং এর সহকারীরা গণধর্ষণের পর হত্যা করে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলায় পঁচিশ মাইল এলাকায় বনে ফেলে রেখে যায়। গত ফেব্রুয়ারী মাসে রূপাকে গণধর্ষণ ও হত্যা মামলায় বাসের চালক এবং তিন সহকারীদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। মানবাধিকার সংস্থা অধিকার এর ডকুমেন্টেশন থেকে জানা গেছে যে ২০১৩ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ১০ জন নারীকে চলন্ত বাসের ভেতরে কিংবা বাস থেকে জোর করে নামিয়ে নিয়ে গণধর্ষণ করা হয়েছে। এঁদের মধ্যে ২ জনকে হত্যাও করা হয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশী বলেই ধারনা করছে অধিকার। রুপা খাতুন ছাড়া চলন্ত বাসে গণধর্ষণের কেউ বিচার পেয়েছেন কি না জানা যায়নি।
কিছুদিন ধরে দেখছি বেশ কিছু সাহসী মেয়ে ফেসবুকে পাবলিক বাসের চালক আর তার সহযোগীদের দ্বারা সংঘটিত যৌন নিপীড়ণের কথা তুলে ধরছেন। গত ১৭ই মার্চে ঢাকায় ‘নিউ ভিশন’ নামের একটি বাসে একটি মেয়েকে যৌন হয়রানী করার কথা মেয়েটি তাঁর ফেসবুকে লেখার পর বাসের চালক এবং সহকারীকে গ্রেফতার করা হয়।এছাড়া ১৭ই মে তে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে ২০মে ঢাকায় চলাচলরত ট্রাস্ট পরিবহনের কয়েকটি বাস আটকে প্রতিবাদ জানায় তার সহপাঠিরা । এর কিছুদিন আগে উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে তুরাগ পরিবহনে যৌন হয়রাণীর প্রতিবাদে তাঁর সহপাঠিরা ৩৫টি বাস আটকে রেখে প্রতিবাদ করে। এরপর পুলিশ তুরাগ পরিবহনের ড্রাইভার ও তার দুই সহকারীকে গ্রেফতার করে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বি আর টি এ)হিসেবে রাজধানীতে বিভিন্ন রুটে প্রতিদিন সাত হাজার বাস চললেও সরকারী পরিবহণ বিআরটিসির বাস মোটে ৪০০টি।(প্রথম আলো ২২ মে, ২০১৮) অর্থাৎ ৬৬০০ টি বাসই বেসরকারী মালাকানায় চালিত হচ্ছে এবং এখানে যাত্রী হয়রানী, অদক্ষ চালক নিয়োগসহ চরম অরাজকতা বিরাজ করছে।ফলে যেনতেন ভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরকার সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মালিকদের বাস চলাচল করে এবং এসব বাসে সঙ্ঘঠিত বেশিরভাগ ঘটনার কোনই বিচার হয়না।এইসব বাসগুলোর চালক এবং সহযোগীদের পর্যাপ্ত তথ্যসহ এদের ফৌজদারি অপরাধমূলক কর্মকান্ডের রেকর্ড সরকারের কাছে আছে কি না সন্দেহ। ঠিকমতো তথ্য না থাকলে অভিযুক্তদের খুঁজে বের করা সহজ নয়। প্রতিটি বাসের চালক এবং সহযোগীদের তথ্য তালিকা বাসগুলোতে ঝুলানো থাকা দরকার এবং সরকারের কাছে এদের তথ্য থাকা প্রয়োজন।প্রতিটি বাসে চালক এবং তার সহকারীদের আইডি কার্ড তাঁদের গলায় ঝুলিয়ে রাখা বাধ্যতামূলক করা দরকা্র। সাম্প্রতিককালে ঢাকায় পরিবহণ মালিকদের সংগঠণ জানিয়েছে যে, ঢাকা শহরের পরিবহন শ্রমিকদের প্রায় ৫০% মাদক সেবন করে। নেশার ঘোরে বাস চালানোর ফলে একদিকে বাসের তলায় চাপা পড়ে যেমন প্রতিদিন অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছেন- সেইসাথে নেশাও মেয়েযাত্রীদের উপর যৌন হয়রানী এবং গণ ধর্ষণের মতো ঘটনার কারণ কি না তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।তাই পাবলিক বাস সহ অন্যান্য পরিবহণের চালকদের মাদকাসক্তির নিয়মিত পরীক্ষা করে দেখা খুব দরকার।যাত্রী নিরাপত্তা বাড়ানো এবং যৌন হয়রানি ঠেকাতে গণপরিবহনে জরুরী সেবার জাতীয় হেল্পডেস্ক নম্বর ৯৯৯ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করার কথা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, বিআরটিএ বললেও অধিকাংশ বাসে তা নেই। বাসগুলোতে ৯৯৯ নাম্বার থাকলে বিপদে পড়লে মেয়েরা অন্তত সাহায্য চাইবার চেষ্টা করতে পারতো।এছাড়া প্রতিটি বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।

বিচারব্যবস্থার চরম দুর্বলতা, আর পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের উপর দোষ চাপানোর প্রবণতার জন্য এদেশে বেশিরভাগ মেয়ে সহজে বিচার চাইতে যায় না। তাও যারা বিচার চায় তাতে কিছু অভিযুক্ত গ্রেফতার হলেও অনেকেই আবার জামিনে বের হয়ে আসে।এই পরিস্থিতি ব্যাপক। বাসে ধর্ষণসহ যৌন হয়রানী গুলোর বিচার না হওয়ায় এগুলো থামানো যাচ্ছে না।

এটি খুব দুঃখজনক যে স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও দেশে সুষ্ঠুভাবে একটি গণপরিবহণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি।সুষ্ঠু এবং পর্যাপ্ত গণপরিবহণ ব্যবস্থা থাকলে সাধারণ মানুষ শান্তিতে চলাচল করতে পারতো এবং যৌন হয়রানী, ধর্ষণ অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব হত। বর্তমানে বাসে খুব অল্প সংখ্যক সিট নারীদের জন্য বরাদ্দ করা আছে- এই সিট পূরণ হয়ে গেলে অনেক ক্ষেত্রেই নারীদের বাসে উঠতে বাধা দেয়া হয় বা উঠলেও তাঁদের ভিড়ের চাপে থাকতে হয় এবং অনেকেই যৌন নিপীড়নের শিকার হন। অন্যদিকে নারীযাত্রী বহনকারী বাসের সংখ্যাও খুব সীমিত হওয়ায় তা বেশিরভাগ নারীদের কোনই কাজে আসেনা। কিন্তু এই নিয়ে সরকারের কোনই মাথা ব্যথা নেই।

পাবলিক বাসে যৌন হয়রানী বা ধর্ষণের শিকার হবার আশংকায় অনেক মেয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সুযোগগুলো নেয় না। যেমন অনেক মেয়েই দূরে কাজ নেওয়া, পড়াশোনা করা বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজ থেকে বিরত থাকেন। অনেকে আবার ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য যানবাহনে উঠতে বাধ্য হন। একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীর সাথে কথা বলছিলাম। তিনি জানালেন যৌন হয়রাণীর আতংকে তিনি আর পাবলিক বাসে উঠেন না ।ভাড়ায় চালিত মোটর বাইক অনেক সময়ই খুব ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে চালায় এবং রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও প্রতিদিন মেয়েটি ভাড়ায় চালিত মোটর বাইকে করেই লালমাটিয়া থেকে বসুন্ধরায় তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। কারণ হিসেবে তিনি জানালেন যে বন্ধ বাসে যৌন হয়রানীর শিকার হলে মোটর বাইকের মত লাফিয়ে নামা সম্ভব নয়- তাই তিনি বাস বাদ দিয়ে মোটর বাইকে চড়া শুরু করেছেন। তিনি আরও জানালেন তাঁর কিছু বান্ধবীও তাই করছে। পাবলিক বাসে যৌন হয়রানীর আতংক এইরকম কত মেয়েদের যে তাড়া করে ফিরছে তার হিসেব কে রাখে?

নীতি নির্ধারণকারী যারা দেশে নারী উন্নয়ণের জয়গান করছেন তাঁরা তাঁদের প্রাইভেট গাড়ী বাদ দিয়ে পাবলিক বাসে চলাচল শুরু করুন- সেখানে নারীদের অবস্থা দেখুন, নিজেরাও বুঝুন কি হচ্ছে- তারপর এইসব জয়গান করবেন কিনা বিবেচনা করুন।সদিচ্ছা থাকলে নারীদের পাবলিক বাসে ধর্ষণসহ যৌন হয়রানী ঠেকানোর জন্য ব্যবস্থা নিন।একটা কথা তো আছে- ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়।

তাসকিন ফাহমিনা; মানবাধিকার কর্মী এবং অধিকার এর জেন্ডার বিশেষজ্ঞ

Subscribe

Subscribe to our e-mail newsletter to receive updates.

, ,