Odhikar

নারীদের প্রতি বৈষম্য ও সহিংসতা বন্ধ করুন

তাসকিন ফাহমিনা, জেন্ডার বিশেষজ্ঞ, অধিকার

১.

কয়েকদিন আগে একটি খবরের দিকে দৃষ্টি আটকে গেল- শিরোনামটি ছিল এই রকম- ‘ছেলে না হওয়ায় মেয়ের মুখে বিষ!’ ঘটনাটি হল- যশোরের অভয়নগরে শফিয়ার- লাবিনা দম্পতির চার মেয়ের মধ্যে তিথিলার তিন মাস আগে জন্ম হয়। ছেলের আশায় এতগুলো মেয়ের জন্মের কারণে ‘আশাহত’ শফিয়ার তিথিলার মুখে বিষ ঢেলে দিলে শিশুটি মারা যায়।(প্রথম আলো, ১লা র্মাচ ২০১৬) বাংলাদেশে এমনিভাবেই অনেক পরিবারের কাছে মেয়েশিশুর জন্ম একে তো কোন আনন্দ বয়ে আনেইনা উপরন্তু কখনো কখনো কোন কোন পরিবারের সদস্যরা তাদের হতাহতের কারণ ঘটান। এঁদের কাছে মেয়ে ‘লাভজনক’ কিছু নয়- বরঞ্চ লোকসান, ঝামেলা এবং র্সবোপরি বোঝা। তাঁরা ছেলের প্রত্যাশা করেন- আর মেয়ে জন্মালে মেয়েগুলো আর তাঁদের মায়ের উপর নেমে আসে অত্যাচার।এদেশে নারী ও মেয়ে শিশুদের জীবন বিপন্ন করা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের সহিংসতা, বৈষম্য, অবহেলা পরিবার থেকে শুরু করে সব র্পযায়ে আছে। এইসব বৈষম্য, সহিংসতা শুধু নারীদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে না- সবাইকেই করছে। জনসংখ্যার ৫০ ভাগকে কষ্টে রেখে কোন্‌ জাতি কবে বড় হয়েছে? অথচ সহিংসতা চলছে- যৌতুক নেয়া এবং এ সংক্রান্ত সহিংসতা, র্ধষণ, এসিড নিক্ষেপ, যৌন হয়রানি, পারিবারিক সহিংসতার ভয়াবহ খবর গুলো আসছেই আর সেই সাথে চলছে বিচারের র্দীঘসূত্রিতা এবং বিচার পাবার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা।

২.

প্রায় ১৬ কোটি মানুষের এই দেশে একদিকে যেমন অনেক মেয়েরা পড়ালেখা- কাজকর্মের জন্য বেরিয়ে পড়েছে- অন্যদিকে তাঁদের এই পথ চলাতে চলছে শত শত হয়রাণি-বাধা-সহিংসতা-বৈষম্য! বহু মেয়েই গণপরিবহন থেকে শুরু করে রাস্তায় চলাচলের ক্ষেত্রে হেনস্থা ও যৌনহয়রাণীর শিকার হচ্ছেন। ২০১৫ সালের ১৪ ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে আসা অনেক মেয়েই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে- অথচ বছর ঘুরে পহেলা বৈশাখ ১৪২৩ সামনের মাসেই আসছে কিন্তু এই জঘন্য ঘটনার এখনো বিচার হলোনা। জানুয়ারি ২০০৯- ফেব্রুয়ারী ২০১৬ সাল র্পযন্ত ১০৭ জন কিশোরী বখাটের অত্যাচার সইতে না পেরে আত্মহত্যা করছেন ও ৩১ জনকে বখাটেরা মেরে ফেলেছে বলে বলে অভিযোগ রয়েছে।(সূত্র অধিকার)- অধিকাংশ ঘটনার কোন বিচার হয়নি- আর তাই অপরাধীর শাস্তি নিশ্চিত করা যায়নি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর ২০১১ সালের জরিপ থেকে  জানা যায় দেশের বিবাহিত নারীদের ৮৭ শতাংশই স্বামীর মাধ্যমে কোন না কোন সময়, কোন না কোন ধরণের নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। পারিবারিক সহিংসতার অনেকগুলো কারণের মধ্যে যৌতুক একটি অন্যতম প্রধান কারণ। শুধু দরিদ্র পরিবারে নয়; স্বচ্ছল ও তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ পরিবারগুলোতেও যৌতুকের লেনদেনের ঘটনা ঘটছে ও যৌতুক না পেলে শারীরিক-মানসিক নিপীড়ন করার ঘটনা ঘটছে। যৌতুক নেয়া বা দেয়া  আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হলেও- একে তো বন্ধ করা  যায়ইনি- বরঞ্চ দিনকে দিন এ যেন বেড়েই চলেছে। বিয়েকে উপলক্ষ্য করে অনেক বরপক্ষ কণেপক্ষের সঙ্গে  চাঁদাবাজি করে- এর অপর নামই হল ‘যৌতুক নেয়া’! অনেক মেয়েই তাঁর যৌতুকের টাকা জমানোর জন্য দিন-রাত খেয়ে-না খেয়ে গার্মেন্টসে কিংবা গৃহকর্মীর কিংবা অনেক ধরণের কষ্টসাধ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করেন এবং বিয়ের পর এঁদের অনেকেই সহিংসতা ও বৈষম্যের শিকার হন। যৌতুক অধিকাংশ ক্ষেত্রে বারবার চাওয়া হয় ও না পেলে বারবার নারীটিকে শারিরীক ও মানসিক নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়। এর ফলে অনেক নারীই আহত বা নিহত হন। যৌতুক এর পরিমান নারীর চেহারা, গায়ের রং ইত্যাদির উপর ভিত্তি করেও নির্ধারিত হয়। গায়ের রঙ অপেক্ষাকৃত গাঢ় হলে যৌতুক বেশী চাওয়া হয়। যৌতুক ও এর সহিংসতা চক্রাকারে পুরো সমাজকে সহিংস করে ফেলছে। একটি চক্রের উদাহরণ দেই। সাবিহারা (ছদ্মনাম) তিন বোন এক ভাই। সাবিহার বিয়ের সময় তাঁর শ্বশুরবাড়ী তাঁর পরিবারের কাছ থেকে এক লক্ষ টাকা যৌতুক চাইল। সাবিহার বাবা ঋণ করে বিয়ের সময় তাৎক্ষনিকভাবে দিলেন পঞ্চাশ হাজার টাকা; বাকী টাকা পরে দেবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের বাকি টাকা আদায়ের জন্য সাবিহার উপর শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন চালাচ্ছিলেন শ্বশুর পক্ষের লোকজন। শেষমেষ স্বামী ও শ্বশুর বাড়ীর মানুষরা মারধর করে সাবিহাকে বাপের বাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। বাপের বাড়ীর মানুষেরাও তাঁকে বোঝা হিসেবেই দেখতে থাকলেন। কিছুদিন পর সাবিহার ভাই কালামের বিয়েতে সাবিহার বাবা চাইলেন দেড় লক্ষটাকা। সাবিহার বাবার ইচ্ছা সেই দেড় লক্ষ টাকার মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা দিয়ে সাবিহাকে আবার তাঁর শ্বশুর বাড়ীতে পাঠাবেন ও দ্বিতীয় মেয়েটিরও বিয়ের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু তা হলো না। সাবিহার ভাইয়ের দরিদ্র শ্বশুর বাড়ী থেকে দেয়া হলো তিরিশ হাজার টাকা ও বাকী টাকা পরে দিবেন বলে তাঁরা প্রতিশ্রুতি দিলেন। সেই টাকা না পেয়ে সাবিহা, তাঁর মা, বাবা, কালাম সবাই মিলে কালামের বউকে বিয়ের ছয় মাসের মাথায় আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেললেন। ফলে সাবিহা প্রথমে ভিক্টিম হলেও- পরবর্তীতে তিনিই অপরাধী হয়ে গেলেন। যৌতূকের জন্য এইরকম চক্রাকারে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। বিয়ে যদি সুন্দর পরিবার গঠনের উদ্দেশ্যে না হয়ে স্ত্রীকে টাকা বানানোর মেশিন বানানোর উদ্দেশ্যে হয়- যেখানে নারীটি টাকা পয়সা লেনদেনের মূল মাধ্যম মাত্র- সেক্ষেত্রে এমন বিয়ের যে প্রয়োজনীতা নেই তা পরিবার ও সমাজকে বুঝতে হবে।

অন্যদিকে ধর্ষণের ঘটনাগুলো ভয়ংকর ভাবে ঘটছে- কয়েক বছরের ধর্ষণের ঘটনাগুলোর রেকর্ড পর্যালোচনা করে উদ্বেগের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে যে প্রাপ্ত বয়স্ক নারীর তুলনায় মেয়েশিশুরা অনেক বেশি ধর্ষণের শিকার হচ্ছে।  জানুয়ারি ২০০৯ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০১৬ সাল পর্যন্ত অন্ততপক্ষে ৪৯১১ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে; এর মধ্যে ৩৯% প্রাপ্ত বয়স্ক নারী এবং ৫৯% মেয়েশিশু।(সূত্র- অধিকার)।গণ ধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা এইসব ঘটনাও ঘটছে অনেক। এখন আবার মরার উপর খাড়ার ঘায়ের মত ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করে ধর্ষণকারী বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে- এতটাই বিকৃত হয়ে পড়েছে এই সব ‘মানুষেরা’। সামাজিক চাপ, লোকলজ্জার ভয়ে বেশিরভাগ ধর্ষণের ঘটনা গোপন করা হয়, আর অনেক ধর্ষণের ঘটনা সালিশ করে মিটিয়ে ফেলা হয় এমনকি ধর্ষণকারীর সাথে নামেমাত্র বিয়েও দিয়ে দেয়া হচ্ছে।

৩।

নারীদের সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু আইন হয়েছে। যেমন- যৌতুক নিরোধ আইন ১৯৮০; নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩); এসিড নিয়ন্ত্রন আইন ২০০২; এসিড অপরাধ দমন আইন ২০০২; পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা আইন) ২০১০ ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা হল- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এইসব আইনের বাস্তবায়ন নেই। বিচারহীনতার সংস্কৃতি থাকায় অধিকাংশ প্রভাবশালী অপরাধী পার পেয়ে যাচ্ছে এবং নির্বিঘ্নে নারীদের উপর আরও সহিংসতা চালাচ্ছে। বিচার ব্যবস্থা নারীবান্ধব না হলে নারীর বিচার পাবার আশা দুরাশাই থেকে যাবে। নারীদের অর্থনৈতিক মুক্তি অত্যন্ত জরুরী। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের ধর্মীয় ও সামাজিক অনুশাসনের মাধ্যমে গরীব করে রাখা হয়- যাতে তাঁরা স্বাবলম্বী হতে না পারেন- সিদ্ধান্ত নিতে না পারেন। সহিংসতার শিকার নারীদের যে ধরণের সহায়তা, পুনর্বাসন এবং কাউন্সেলিং প্রয়োজন তা ভীষণভাবে অপর্যাপ্ত।কুসংস্কার ও সচেতনতার অভাব নারীর উপর সহিংসতার মূলে অবস্থান করছে। ঘুমন্ত ও কুসংস্কারচ্ছন্ন অবস্থা থেকে মানুষকে জাগানোর জন্য প্রয়োজন ব্যাপক ও নিয়মিত প্রচারণার। এক্ষেত্রে মিডিয়ার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। মেয়েদের উপর সহিংসতা বন্ধের জন্য অনেকদিন ধরেই কোন নিয়মিত ও দীর্ঘমেয়াদি মিডিয়া প্রচারণা দেখা যাচ্ছে না। অথচ প্রতিদিনই রেডিও, টেলিভিশন, সংবাদপত্রসহ বিভিন্ন মাধ্যমে নারীর উপর সহিংসতা বন্ধের জন্য প্রচারণা চালানো অত্যন্ত জরুরী। পাঠ্যবইয়ে লৈঙ্গিকসমতা বিষয়ে ব্যাপক ধারণার মাধ্যমে নারীর উপর সহিংসতা ও বৈষম্য কতটা ক্ষতিকর- এই বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস- এবারে জাতিসংঘও এ দিবস উপলক্ষে ২০৩০ সালের মধ্যে সারা পৃথিবীতে লৈঙ্গিকসমতা আনার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়েছে- আর এই লৈঙ্গিকসমতা সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়ন করতে হলে সব মহলকে আন্তরিকভাবে বহু কঠিনপথ নিরলসভাবে পাড়ি দিতে হবে।

Subscribe

Subscribe to our e-mail newsletter to receive updates.