Odhikar

তনুর লাশ এদেশে নারীর নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি

*তাসকিন ফাহমিনা

১।

এদেশে বিচার পাবার জন্য বিক্ষোভ, সমাবেশ, মানববন্ধন, লেখালেখি, কত কিছু যে করতে হয় তার কোন ইয়ত্তা নেই- তবুও সহজে অপরাধীর শাস্তি হয়না- বিচার  মেলেওনা বেশীরভাগ সময়।এর ওপর বর্তমান পরিস্থিতিতে মতপ্রকাশ এর স্বাধীনতা অনেকভাবে বাধাগ্রস্ত। বিভিন্ন ইস্যু ও ঘটনাপ্রবাহের তীব্রতা ভেদে সরকারের বাহিনী ও সংস্থার আচার আচরণও মারমুখি।এইতো গতবছর ১৪ই এপ্রিল পহেলা বৈশাখ উদযাপনকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতে আসা অনেক মেয়ে যৌণ হয়রানীর শিকার হন- অথচ প্রায় এক বছর হতে চলেছে- তবু এই জঘন্য ঘটনার বিচার হলোনা। উপরন্তু বর্ষবরণ উৎসবে যৌন নিপীড়নে জড়িতদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবিতে গত বছরের ১১ মে’তে ছাত্রদের ডিএমপি কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি লাঠিপেটা ও জলকামান ছুড়ে পণ্ড করে দেয় পুলিশ। এই সময় ৩৪ জন ছাত্র -কর্মী আহত হন। পুরুষ পুলিশ কয়েকজন নারীকর্মীকে ধাওয়া করে মাটিতে ফেলে পেটাতে থাকে।এই হল  অন্যায়ের বিরদ্ধে প্রতিবাদকারীদের উপর পুলিশি আচরন। ফৌজদারি অপরাধ ঘটলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই  আইন স্বাভাবিক নিয়মে চলে না- দুর্নীতি, ঘটনার সঙ্গে জড়িত প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ, দলীয় রাজনীতির প্রবল থাবা এরকম আরও হাজারো কারণে বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে দিনে দিনে মানুষ অসহায় হয়ে পড়ছে।দেশে অন্যায়- অবিচারের প্রতিকার নেই- আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দায়হীনতা চরম।আইনের শাসন বহাল রাখার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আছে- এদের পিছনে জনগণের কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে- কিন্তু মানুষ বিচার পাচ্ছে না।গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলার ঘটনাগুলো কেন এত বেশি ঘটছে? কেন মানুষ আইন হাতে তুলে নিচ্ছে? একটু খেয়াল করলে- একটু কান পাতলে শোনা যায়- বোঝা যায়- সাধারণ মানুষ ভীষণ ভাবে  অসহায় এবং ক্ষুব্ধ- ফলে হিংস্রতা বাড়ছে- অপরাধী অপরাধ করে পার পেয়ে যাবে- এই ধারণা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। যে কারণে সামাজিক অস্থিরতা আর অবক্ষয় হয়ে পড়েছে সীমাহীন।

 ২।

এদেশে এমনিতেই পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদের পথচলায় অনেক অনেক বাধা। বৈষম্য, বঞ্চনার মধ্য দিয়ে মেয়েদের অনেক সংগ্রাম করে চলতে হয়। পদে পদে  বিপদ- যৌণ হয়রানি, ধর্ষণ, এসিডে ঝলসে দেয়া- যৌতুক আর এর সহিংসতা, পারিবারিক সহিংসতা আরও কত কি! অস্বচ্ছল পরিবারে মেয়েদের বিপদ তো আরও বেশি করে চারিদিক অন্ধকার করে আসে। সবচেয়ে বড় হল- নিরাপত্তার অভাব। অনেক মা বাবা- ভয় পেয়ে ১২/১৩ বছরের মেয়েকে তথাকথিত ‘নিরাপত্তার’ স্বার্থে বিয়ে দিয়ে দেন- এইসব মেয়েরা স্কুলের গণ্ডিও পার হতে পারেনা- এবং পরে তাঁদের অনেকেই পারিবারিক সহিংসতার শিকার হন এবং বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য তো আছেই। তবুও এরই মাঝে অনেক পরিবার আর তাঁদের সংগ্রামী মেয়েরা বিভিন্ন বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেন। কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের ইতিহাস বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী ও নাট্যকর্মী ১৯ বছর বয়সী সোহাগী জাহান তনুও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তনু দুটো টিউশনি করতেন।কিন্তু হঠাৎ করে বলা নেই কওয়া নেই গত ২০ মার্চ ফুটফুটে মেয়েটি লাশ হয়ে গেল। তনুর বাবা ইয়ার হোসেনের বক্তব্য পড়ছিলাম- কুমিল্লার ময়নামতি সেনানিবাস এলাকাতে প্রতিদিনকার মত সেদিন বিকেলেও  তনু ছাত্র পড়াতে গিয়েছিলেন। বাড়ি ফিরে না আসায় রাত সোয়া দশটার দিকে তিনি একটি টর্চ হাতে তনুর খোঁজে বের হন। তাঁদের বাসার কাছেই একটি কালভার্ট। এর  পাশেই দেখেন তনুর একটি জুতা পড়ে আছে। জুতা দেখে চিৎকার করে উঠেন তিনি।  আর কিছু দূরে তনুর মোবাইল ফোনটা পড়েছিল।একটু উঁচু জায়গায় জঙ্গলের মধ্যে খুঁজতে গিয়ে তিনি তনুর লাশ দেখতে পেলেন। লাশের মাথার নিচটা থেঁতলে আছে।  মুখে রক্ত আর আঁচড়ের দাগ। এই ঘটনাটির বর্ণনা যখন পড়ছিলাম তখন বারে বারে শিউরে উঠছিলাম- মনে হচ্ছিল আমি ১৯৭১ সনের পাকবাহিনীর হাতে আমাদের নিপীড়িত- নিহত নারীদের ঘটনার বর্ণনা পড়ছি।

Tonu_By_Taskin-Fahmina_Odhikar_29.03.16                                                             সোহাগী জাহান তনু : হত্যাকাণ্ডের শিকার ২০ মার্চ ২০১৬

তনুকে ধর্ষণের চেষ্টার পর হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় এই ধরণের ভয়ানক ঘটনা ঘটল- হত্যার এক সপ্তাহ পার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও আসামীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা যায়নি।।এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তনুর বাবা ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডের কর্মচারী অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের নামে কোতোয়ালি মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি ২৫ শে মার্চ পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কাছে হস্তান্তর করা হয়।পত্রিকাতে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায় এরই মাঝে ২৫ শে মার্চ রাতে এবং ২৬ শে মার্চ দুপুরে তনুর শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের বাড়ি থেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন র‌্যাব ও পুলিশ সদস্যরা। গভীর রাতে বাসায় র‍্যাব আসায় পরিবারটি ভয় পেয়ে যায়।তনুর সঙ্গে কুমিল্লা সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের কোনো শিক্ষার্থীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল- এমন স্বীকারোক্তি আদায়ে চাপ দেয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন তনুর পরিবার।ভিক্টিম পরিবারের প্রতি র‍্যাব- পুলিশের এই ধরণের  হয়রানিমূলক আচরন এবারও বরাবরের মত প্রশ্নবিদ্ধ।

৩।

এদেশে প্রতিদিন মেয়েরা লাশ হচ্ছে্ন- ধর্ষণ সহ বিভিন্ন সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। কোনটার খবর আসছে- বেশিরভাগই চাপা পড়ে যাচ্ছে। অধিকার এর তথ্যানুযায়ী  ২০০৯ থেকে ফেব্রুয়ারী ২০১৬ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৫৮ জন নারী ও মেয়ে শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এ সময়ে মোট ধর্ষণের শিকার হয়েছেন অন্ততপক্ষে ৪৯১৬ জন। এছাড়া গণ ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে অনেক- যার সংখ্যা ১৫৮৯ জন।

বাংলাদেশে একশ্রেণীর সুবিধাভোগী মানুষেরা সুযোগ পেলেই এদেশে নারীর ব্যাপক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন হয়ে যাচ্ছে বলে মহা জোরেসোরে প্রচারণা চালান।অথচ যথার্থ উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন হলে নারীরা নিরাপত্তা পেতেন, বিচার পেতেন-  নারীদের অবস্থা কখনোই এত শোচনীয় হতোনা।রাষ্ট্র বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই নারীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। নারীদের নিরাপত্তা নেই ঘরে-রাস্তাঘাটে, গণপরিবহনে- শিক্ষাঙ্গনে- কর্মক্ষেত্রে- কাস্টডিতে এমনকি তথাকথিত সুরক্ষিত সেনানিবাসেও- কোথাও নিরাপদে থাকতে পারছেন না সাধারণ নারীরা। অধিকার লঙ্ঘিত হলে সহজে বিচার পাওয়া ভিক্টিম নারী ও তাঁদের পরিবারের কাছে যেন দুরাশা। কি সংখ্যাগুরু- কি সংখ্যালঘু- কি পাহাড় কি সমতল- সব জায়গায় নারী নিষ্পেষিত, অত্যাচারিত, ধর্ষিত, নিহত। তনুর মৃত্যুর পর কুমিল্লা উত্তাল হয়েছে- এই উত্তালতা ছড়িয়ে গেছে সারা দেশের মানুষের মাঝে। তনুর মৃত্যু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এদেশের নারীদের নিরাপত্তার সঙ্কট কতটা তীব্র। নারীসহ দেশের সাধারণ জনগনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ৪৫ বছর বয়সী বাংলাদেশে কিশোরী তনুদের ওপর নিপীড়ন- হত্যা  আর দেখতে চাই না। এজন্য তনু হত্যার সুষ্ঠু বিচার যে হতেই হবে! তনু হত্যার ক্ষোভ রুপান্তরিত হোক শক্তিতে- আর তা ছড়িয়ে পড়ুক সব অপশক্তিকে রুখে সুশাসন ও জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে।

*তাসকিন ফাহ্‌মিনা মানবাধিকার সংস্থা অধিকার– এর সঙ্গে সম্পৃক্ত জেন্ডার বিশেষজ্ঞ; email- taskin133@gmail.com

Subscribe

Subscribe to our e-mail newsletter to receive updates.