Odhikar

অধিকার এর ওপর চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের দশ বছর

১০ অগাস্ট অধিকার এর ওপর চরম রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন শুরু হওয়ার দশ বছর। ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ওপর অধিকার তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করায় ২০১৩ সালের ১০ অগাস্ট অধিকার এর সেক্রেটারি আদিলুর রহমান খানকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)’র সদস্যরা তুলে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে আদিলুর রহমান খান এবং অধিকার এর পরিচালক এএসএম নাসির উদ্দিন এলানকে নির্বতনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ (সংশোধনী ২০০৯) এ অভিযুক্ত করা হয়। তাঁরা যথাক্রমে ৬২ ও ২৫ দিন কারাগারে আটক থাকার পর জামিনে মুক্ত হন। দীর্ঘ ১০ বছর ধরে তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা চলমান আছে এবং যে কোন দিন এই মামলার রায় দেবে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া ২০১৩ সালের ১১ অগাস্ট গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা অধিকার কার্যালয়ে তল্লাশী চালিয়ে ল্যাপটপ ও ডেস্কটপ এবং এর ভেতরে সংরক্ষিত বিভিন্ন ডক্যুমেন্ট নিয়ে যায়, যেখানে নারীর প্রতি সহিংসতার শিকার ভিকটিমসহ বিভিন্ন ভিকটিম ও তাঁদের পরিবারের সংবেদনশীল তথ্যও ছিল। অধিকার অদ্যাবধি ঐ কম্পিউটার ও ডক্যুমেন্টগুলো ফেরত পায়নি। গত ১০ বছর ধরে অধিকার এর কর্মীরা প্রতিনিয়ত গোয়েন্দা নজরদারি, হয়রানি এবং হুমকির শিকার হয়েছেন এবং তাঁদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হয়েছে। অধিকার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নারী মানবাধিকারকর্মীদের অনেকেই গোয়েন্দা নজরদারি, হয়রানির কারণে নিরাপত্তার অভাবে মানবাধিকার কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়েছেন। ২০১৪ সাল থেকে স্ট্যান্ডার্ড চাটার্ড ব্যাংক সরকার কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে অধিকার এর একাউন্টগুলো স্থগিত করে। ফলে অধিকার এর মানবাধিকার কর্মকাণ্ডগুলো প্রচণ্ডভাবে বাধাগ্রস্ত হয়।

গত ১০ বছরে অধিকার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানবাধিকারকর্মীরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে আক্রান্ত হয়েছেন এবং নিবর্তনমূলক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আটক থেকেছেন। ২০১৩ সালের ১০ অগাস্ট থেকে শুরু করে বর্তমান সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অধিকার এর বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট প্রপাগন্ডা ছড়ানো হয়, যা এখনও অব্যাহত আছে। সরকার গত ১০ বছরে অধিকার কে হয়রানি করা এবং অধিকার এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর নিপীড়ন চালানোর জন্য সরকারী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করে। এরমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও নির্বাচন কমিশন রয়েছে। সরকারের আজ্ঞাবহ দুর্নীতি দমন কমিশন অধিকার এর বিরুদ্ধে তদন্ত চালিয়ে কিছু না পেয়ে ছাড়পত্র দেয়। অন্যদিকে ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশতম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অধিকার যাতে পর্যবেক্ষণ করতে না পারে সে জন্য সরকারের আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন আইন ও বিধির তোয়াক্কা না করে নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে অধিকার এর নিবন্ধন একতরফাভাবে বাতিল করে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনস্ত এনজিও বিষয়ক ব্যুরো অধিকার এর নিবন্ধন নবায়ন এর আবেদন ৮ বছর ঝুলিয়ে রেখে তা নবায়ন করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অধিকার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব বরাবর এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর আইনানুযায়ী আপিল দায়ের করলে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অধিকার এর নিবন্ধন নবায়ন না করার ব্যাপারে এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর সিদ্ধান্ত বহাল রাখে।

গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিনাবিচারে আটক, স্বাধীন মতপ্রকাশে বাধা ও হেফাজতে নির্যাতনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস মেকানিজমের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে অধিকার এর ওপর এই নিপীড়ন নেমে এসেছে। সরকার অধিকার এর মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকাণ্ডকে ‘রাষ্ট্রবিরোধী’ এবং ‘সরকারবিরোধী’ কার্যকলাপ হিসেবে আখ্যা দিচ্ছে; কারণ অধিকারকে বন্ধ করে দিতে পারলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার অসংখ্য ভিকটিমের কণ্ঠরোধ করা সম্ভব হবে। যেকোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাধাহীনভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে এবং সরকারকে মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধের ক্ষেত্রে সহায়তা করে। নিপীড়নমূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই কেবলমাত্র স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে কাজ করতে বাধা দেয়া হয় এবং মানবাধিকারকর্মীরা নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হন। অধিকার বাংলাদেশে এমন ধরনেরই এক পরিস্থিতির শিকার। চরম নিপীড়নমূলক পরিস্থিতিতেও অধিকার এর সঙ্গে যুক্ত মানবাধিকারকর্মীরা মানবাধিকার রক্ষার সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকার কারণেই তাঁরা এখনও কাজ করে চলেছেন। অধিকার মনে করে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন করতে পারলেই কেবল বাংলাদেশের জনগণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম অবস্থা থেকে মুক্ত হবে।

 

সংহতি প্রকাশে,

অধিকার টিম

Subscribe

Subscribe to our e-mail newsletter to receive updates.