বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসন ও সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবাদে অধিকার এর বিবৃতি
ঢাকা, জানুয়ারি ৭, ২০২৫: ৭ জানুয়ারি ২০২৫ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র হাতে বাংলাদেশী কিশোরী ফেলানী খাতুন হত্যার ১৪তম বার্ষিকী। ২০১১ সালের এই দিন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ’র সদস্যরা বাংলাদেশ ভারত-সীমান্তে কিশোরী ফেলানী খাতুনকে গুলি করে হত্যা করে এবং তার লাশ সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলিয়ে রাখে। কিন্তু ফেলানী হত্যার সঙ্গে জড়িত বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ এবং নির্দেশদাতা তার উদ্ধতন কর্মকর্তার কোনো শাস্তি হয়নি। ফেলানী হত্যা ছিল বিগত কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের আগ্রাসী ভূমিকার একটি নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। শিশু থেকে শুরু করে যে কোন বয়সের বাংলাদেশী নাগরিককে নির্বিচারে হত্যা-নির্যাতন বিএসএফএর কাছে নতুন নয়। প্রতি বছরই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় বহু সংখ্যক বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফ’র গুলিতে অথবা নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করছেন এবং আহত হচ্ছেন। অনেক সময় বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে লঙ্ঘন করে বিএসএফ’র সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে লুটপাট করছে এবং বাংলাদেশী নাগরিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। ফেলানীকে হত্যার আগে ২০১০ সালে বিএসএফের নির্যাতনে হাসনাত হালশাম ইনু (১৫) নামে এক স্কুল ছাত্র নিহত হন। এরপর ফেলানী হত্যাকান্ডের পরও খুনী বিএসএফ শিশু কিশোরদের হত্যা অব্যাহত রাখে। ২০১৫ সালে বিএসএফ গুলি করে হাসানুজ্জামান (১৬) নামে এক স্কুল ছাত্র, ২০১৭ সালে সোহেল রানা ও হারূন অর রশীদ নামে দুইজন স্কুল ছাত্রকে, ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট মৌলভীবাজার জেলার লালারচক সীমান্তে স্বর্ণাদাস নামে এক ১৪ বছরের কিশোরীকে এবং ৮ সেপ্টেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তে জয়ন্ত কুমার সিংহ নামে এক ১৫ বছরের কিশোরকে হত্যা করে। ভারতীয় বিএসএফ বাহিনীর হাতে নিহত বা নির্যাতিত একজনও বাংলাদেশি আজ পর্যন্ত কোন বিচার পাননি।
এমনকি হাসিনার শাসনমলে বাংলাদেশী নাগরিকদের গুম করে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
অধিকার বিএসএফ এর হাতে বাংলাদেশী নাগরিকদের হত্যা-নির্যাতনসহ সমস্ত মানবাধিকার লংঘনমূলক ঘটনাগুলোর এবং ভারতের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানাচ্ছে।
অধিকার এর তথ্য অনুযায়ী ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের নভেম্বর পর্যন্ত বিএসএফ ৫৮৮ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া ৭৭৩ জন বাংলাদেশী বিএসএফ সদস্যদের হাতে আহত হয়েছেন বলে জানা যায়।
আন্তর্জাতিক আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী নিজের সীমানা, ভূখন্ডের অখন্ডতা, সার্বভৌমত্ব ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের উপযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পতিত কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় টিকে থাকতে দলীয় স্বার্থ রক্ষার্থে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ভারত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নতজানু পরাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করে। এই সুযোগে ভারত সরকার তার বিভিন্ন অন্যায় কর্মকান্ড- বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দিয়ে তার স্বার্থ হাসিল করে নেয়। ২০১০ সালে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং যে চুক্তি স্বাক্ষর করেন তার বিষয়বস্তু গোপন করে জাতীয় সংসদে কোন আলোচনা ছাড়াই সেটি সম্পাদিত হয়েছিল। এই চুক্তির পর থেকেই বাংলাদেশের ওপর ভারতের আগ্রাসী নীতি জোরালো হয়। যার ধারাবাহিকতায় ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত ও প্রহসনমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোতে সরাসরি হস্তক্ষেপ করার মধ্যে দিয়ে ভারত সরকার বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই প্রহসনমূলক নির্বাচনগুলো বাংলাদেশে ব্যাপক রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল।
৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের পর শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকে ভারতীয় শাসকগোষ্ঠি বিভিন্নভাবে এই অভ্যূত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সময়ে ভারতীয় কিছু সংবাদ মাধ্যম মিথ্যা ও মনগড়া সংবাদ পরিবেশন করে আসছে ।
অধিকার মনে করে, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র কখনোই এর ভূমি ও নাগরিকদের ওপর অপর রাষ্ট্র কর্তৃক আগ্রাসন এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন মেনে নিতে পারে না। এই রাজনৈতিক ও অথনৈতিক আগ্রাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সোচ্চার হতে হবে- কারণ এই ধরনের আগ্রাসন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে, যা দক্ষিন এশিয়ার জন্যও বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
সংহতি জানিয়ে
অধিকার টিম
www.odhikar.org
https://www.facebook.com/Odhikar.HumanRights/